রাত হলেই জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের কালো চুলের চেয়েও গভীর অন্ধকার নামে এই বাংলার পল্লী গাঁয়ে। ফেলে আসা হাজার বছর ধরে বাঙালি সেই অন্ধকারে আলো আনতে জ্বালাতো কুপি বাতি। বিজ্ঞানের আগ্রাসন আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছে কুপি বাতি জ্বালানোর দায় থেকে এবং সেই সাথে ‘কুপি’ বাতিকে পাঠিয়ে দিয়েছে জাদুঘরে। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘কুপি’
হাজার বছরের রাত
Night of a Thousand Years
একটা সময় ছিলো যখন হাজার বছরের বৃদ্ধ রাতটা বাংলার ঘরে ঘরে হানা দিতেই বউ-ঝিয়েরা কুপিবাতি জ্বালাতো। সেই কুপির আলোয় মা রান্না করতো, বোন সুঁই সুতা হাতে শেলাই করতে বসতো, বৃদ্ধ পিতামহ মনের আনন্দে পান সুপারি ছেঁচত, পাশের বাড়ীর জমির মুন্সি দাওয়ায় বসে সুর করে পুঁথি পড়তো কিংবা মতিনের মা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতো বাড়ীর পাশের জঙ্গলে। এই সময়ে পল্লীর এই চিরায়ত রূপের পরিবর্তন এসেছে। সন্ধ্যা নামার আগেই এখানে জ্বলে উঠে ইলেক্ট্রিক বাতি। আজকাল কুপি-বাতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব এবং পাড়া গাঁয়ে খোঁজ নিলে দেখা যাবে একবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া অনেক ছেলেই কুপি বাতি হয়তো চোখেই দেখেনি।
কুপি বাতি
Traditional Kerosene Lamp
এদেশে নানা প্রকার কুপি বাতি পাওয়া যেতো। মাটি, বাঁশ, লোহা, কাঁচ, সিলভার বা পিতল দিয়ে তৈরি করা হতো সেসব কুপিবাতি। উপাদানভেদে এদের দাম হতো বিভিন্ন। সামর্থ অনুযায়ী লোকজন কিনে ব্যবহার করতো। কুপিগুলোর গায়ে খোঁদাই করা থাকতো বাহারি নকশা। মাটি বা কাঠ দিয়ে তৈরী করা হতো নানান সাইজের স্ট্যান্ড যাতে কুপি রাখলে আলো বেশি পাওয়া যায়। এক তাক বা দুই তাক এবং একনলা বা দুনলা সহ বিভিন্ন সাইজ ও আকারের কুপি বাজারে পাওয়া যেতো।
কুপিতে আগুন জ্বালানোর জন্য সলতের প্রয়োজন হতো আর সেই সলতো বানানো হতো কাপড়ের তেনা ( নেকড়া) কিংবা পাটের সুতলি দিয়ে। সলতের পুরোটা কুপির ভিতরে ডুকিয়ে রাখা হতো শুধু একটা অংশ কুপির নল দিয়ে বাইরে বের করে রাখা হতো যেখানে আগুন জ্বলানো হতো। প্রতিরাতেই নল দিয়ে বের করা অংশটুকু পুড়ে যেতো এবং পরের দিন সলতের আরো কিছুটা অংশ বের করা হতো। কুপিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো কেরোসিন তেল। এদেশের হাজার হাজার মানুষ কুপিবাতি তৈরি ও বিপনন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেসব মানুষেরা আজকাল অন্য কোন পেশা বেছে নিয়েছে আমরা চাইলেও আবার কুপি বাতি ফিরিয়ে আনতে পারবো না আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। তবে এই অন্ধকার বাংলা আরোও এক হাজার বছর ধরে পল্লী জননীর হাতে জ্বালানো কুপির কথা মনে করে নস্টালজিক হবে।
লিখেছেন : জাহিদ হাসান | লেখকের ফেসবুক প্রফাইল : Nucleus Jahid
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
