শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন: বাঙালির চিত্রকলার পথিকৃৎ
Zainul
Abedin
.
যার অঙ্কন শৈলীর শক্তিমত্তা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেশের দুর্ভিক্ষের করুণ বাস্তব দৃশ্যাবলিকে তিনি তুলির মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, এমন উদাহরণ উপমহাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম খ্যাতিমান বাঙালি চিত্রশিল্পী।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আঁকা তাঁর স্কেচগুলো শুধু শিল্পকর্ম নয়, একেকটি ঐতিহাসিক দলিল। এই সিরিজের বেশিরভাগ ছবিতে মায়ের দুঃখ এবং শিশুর অসহায়ত্বের করুণ রূপ ফুটে উঠেছে। মা ও শিশুর সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আঁকা তাঁর এই চিত্রগুলো একদিকে যেমন মর্মস্পর্শী, অন্যদিকে তেমনি সমাজের গভীর দারিদ্র্য ও অসাম্যের প্রতিবিম্ব।
কলকাতায় ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ নিয়ে আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে এই দুর্ভিক্ষ সিরিজ প্রদর্শিত হয়। তাঁর এসব চিত্রকর্ম দেখে ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ শ্রীমতি সরোজিনী নাইডু মন্তব্য করেছিলেন, ‘সব চাইতে মর্মস্পর্শী ও আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তাঁর এসব ছবির আবেদন অধিকতর।’
জয়নুল আবেদিনের এই চিত্রকর্মগুলো কেবলমাত্র শিল্পকলার দিক থেকেই নয়, বরং সমাজ ও ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আজও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে শিল্প শুধু সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, এটি সমাজের সত্য এবং দুঃখ-যন্ত্রণার প্রতিবিম্বও হতে পারে।
জয়নুল উৎসব ২০২৪
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর ২৯ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে জয়নুল উৎসব ও মেলার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। সকালে শিল্পাচার্যের সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা।
জয়নুল উৎসব ২০২৪। ২৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, তিনদিন ধরে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই চলবে এই লোকজ মেলা বা জয়নুল মেলা।
শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) সকাল ১০টা চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ প্রফেসর এম জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
এ মেলায় ঠাঁই পায় লোকজ জীবনের নানা অনুষঙ্গ। নাগরিক জীবনের কাছে এসে হাজির হয় প্রান্তিক জীবনের স্পর্শময় মৃৎশিল্প থেকে কারুশিল্প। সেই সুবাদে জয়নুল মেলায় মেলায় দেখা মিলে মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পালের শখের হাঁড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রুনা বেগমের নকশিকাঁথা, রেহানা পারভিনের মণিপুরী তাঁত কিংবা মৌলভীবাজারের হরেন্দ্র কুমার দাসের শীতল পাটি। রয়েছে রংপুরের শতরঞ্জি থেকে ধামরাইয়ের কাঁসাশিল্প। অথ্যাত ধাতব শিল্প, শোলা শিল্প, মাটির পুতুল শিল্প, কাঠের পুতুল শিল্প, পাখা শিল্প, নকশী কাঁথা শিল্প, পট শিল্প, শীতলপাটি শিল্প, শখের হাঁড়ি শিল্প, মনিপরি তাঁত শিল্প, সতরঞ্জি শিল্প, শঙ্খ শিল্প, মুখোশ শিল্প, বাঁশি শিল্প, হস্ত শিল্পসহ আরও অনেক শিল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন শিল্পীরা। এ এক প্রান্তিক শিল্পীদের মিলনমেলা।
আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
এখানে দেখুন জয়নুল উৎসবের ছবি
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের
বিখ্যাত সব শিল্পকর্মগুলো
.
‘দুর্ভিক্ষ’ চিত্রমালা ছাড়াও বিদ্রোহী, মুক্তিযোদ্ধা, গুনটানা, সাঁওতাল রমণী, সংগ্রাম, গ্রামীণ নারীর চিত্রমালা শীর্ষক ভাস্কর্য শিল্পকলায় অক্ষয় হয়ে আছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বাংলার প্রকৃতি, জীবনাচার, প্রাচুর্য, দারিদ্র্য ও বাঙালীর স্বাধীনতার স্পৃহা তার রং-তুলি আর ক্যানভাসে মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর বিখ্যাত সব শিল্পকর্মগুলো হচ্ছে- ১৯৫৭-এ নৌকা, ১৯৫৯-এ সংগ্রাম, ১৯৭১-এ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ম্যাডোনা প্রভৃতি। তার দীর্ঘ দুটি চিত্রকর্ম ১৯৬৯-এ অঙ্কিত ‘নবান্ন’ এবং ১৯৭৪-এ অঙ্কিত ‘মনপুরা-৭০’ বিশ্বে জননন্দিত দুটি শিল্পকর্ম।








Zainul Abedin painting
জয়নুল আবেদিনের ‘সাঁওতাল দম্পতি’ বিক্রি হলো চড়া দামে
জয়নুল আবেদিনের সৃষ্টি আমাদের অমূল্য সম্পদ। টাকার অঙ্কে তার শিল্পকর্ম মূল্যায়ন বা শিল্পমূল্য হয় না। তবুও অনেক খারাপ খবরের ভিতর ভালো খবর হলো, মার্চের ১৮ তারিখ নিউইয়র্কে এক নিলামে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ‘সাঁওতাল দম্পতি’ চিত্রকর্মটি বিক্রি হয়েছে তিন লাখ ৮১ হাজার ডলারে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় যা চার কোটি ১৭ লাখ সাড়ে ছয় হাজার টাকা। এটিই বাংলাদেশের কোনো শিল্পীর শিল্পকর্মের জন্য এটিই সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হওয়ার রেকর্ড।
পেইন্টিংটি প্রাপ্তির উৎস হিসেবে বলা আছে, ১৯৬৩ সালে সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকে জামশেদ কে. মার্কার এবং ডিয়ানা জে. মার্কার এটি পেয়েছেন। এই দুইজনই জয়নুল আবেদিনের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।
জানা যায় যে কাঠের প্যানেলে তৈল মাধ্যমে জয়নুল আবেদিন ‘সাঁওতাল দম্পতি’ প্রথম এঁকেছিলেন ১৯৫১ সালে। পরে ছবিটির একাধিক সংস্করণও করেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সদবি নিলাম হাউসে নিলামে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দুটি চিত্রকর্ম। এর একটি হলো তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘সাঁওতাল দম্পতি’ এবং অন্যটি এক বসে থাকা নারীর তেলচিত্র। বসে থাকা নারীর এ চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলারে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৩ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার ৬২৩ টাকার সমান।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অবদান
আর্ট ইন্সটিটিউট স্থাপন
চিত্রশিল্পকর্মে উপমহাদেশে বিশেষকরে বাংলাদেশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলো, তারপর কলকাতা আর্ট স্কুলে তাঁর চাকরি ছেড়ে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন জয়নুল। জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ বাড়িতে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু হয়।
জয়নুল আবেদিন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় জয়নুল আবেদিনের এই উদ্যোগটি ছিল রীতিমতো বিপ্লবাত্মক ঘটনা। তখন থেকেই তিনি এদেশে শিল্প আন্দোলন শুরুর গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট শাহবাগে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারী কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়”। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর এ প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়’। জয়নুল আবেদিন ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা
জয়নুল আবেদিনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপিত হয়। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই জাদুঘরে সংরক্ষিত হবে দেশের মূল্যবান লোকশিল্প, ভবিষ্যত্ প্রজন্ম এখান থেকেই নতুন প্রেরণা পাবে। তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প যাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছেলেবেলা এবং শিক্ষাজীবন
জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহুকুমার কেন্দুয়াতে বর্তমান নেত্রকোনা জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর), মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনায় হাতেখড়ি পরিবারের অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলেই।
জয়নুল আবেদিনের শৈশব কাটে কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়া উপজেলায়। তার চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নদী, গাছপালা এবং গ্রামীণ জীবনের নান্দনিক রূপ ছোটবেলা থেকেই তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যতের শিল্পকর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস ঘুরে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখা বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুসমর্থনে গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। তার মা জয়নুল আবেদিনের আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার তখনকার আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে সাহায্য করে ।
জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রতি শ্রদ্ধা
দীর্ঘ ছ’মাস ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন পথিকৃৎ এই চিত্রকর। চারুকলা ইনস্টিটিউটে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি শিল্পের পথে নিবেদিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষায় ও সুস্থ মননসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জীবনকর্মসহ দেশের অতীত ঐতিহ্য, চিত্রশিল্প গুরুত্ব বহন করে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রীহত নকশিকাঁথা প্রদর্শনী
জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষ বা জীবনের বিপন্নতার মতোই মানুষের জীবনের স্বপ্ন আঁকার ছবিটাও ধরে রাখতে চেয়েছেন। এ প্রয়াসেই তিনি লোকশিল্পের নানা সামগ্রীর মতোই গ্রামীণ নারীর স্বপ্ন এঁকে রাখা নকশিকাঁথা সংগ্রহ করতেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবাষির্কী উপলক্ষে তার সংগ্রহ থেকে নির্বাচিত নকশিকাথাঁ গুলো দিয়ে বেঙ্গল শিল্পালয় প্রদর্শনী আয়োজন করে।
আপনার একটি শেয়ার এবং মন্তব্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা ❤️
জয়নুল জন্মোৎসব
ব্রহ্মপুত্রের সন্তান শিল্পী জয়নুল আবেদিন জন্মোৎসব
ছবিসূত্র : ইন্টারনেট
তথ্যসুত্র: https://bangladeshtimes.com/biography/
https://en.wikipedia.org/wiki/Zainul_Abedin
গ্রাফিক্স : FXYZ
আরও পড়ুন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । Zainul Abedin
bdfashion archive
চিত্রশিল্পী সৌরভের ‘শাশ্বত অস্তিত্ব’
bdfashion archive
ভাস্কর শামীম সিকদার | SHAMIM SIKDER
mohammad asad
শিল্পী এস এম সুলতান | S M Sultan
fayze hassan
একজন ধ্রুব এষ | Dhruba Esh
fayze hassan